শনিবার, ৩১ অগাস্ট ২০২৪, ০৬:৩০ অপরাহ্ন

কেমন আছেন ফুটবলের কারিগর ? খোঁজ রাখে না কেউ!

ডি এইচ দিলসান:: গোটা দেশ ছাপিয়ে দেশের বাইরেও যে মানুষটিকে ফুটবল ওস্তাদ নামে সবাই যাকে এক নামে চেনে তিনি হলেন যশোরের ওয়াজেদ গাজী। সাবেক জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ও পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় দলের সাড়া জাগানো খেলোয়াড় ওস্তাদ ওয়াজেদ গাজী জীবনের শেষ বেলায় এসে এখন পাচ্ছেন না তিনবেলা ভালো-মন্দ খাবার। অসুখে জোটে না ওষুধও। স্মৃতিশক্তি অনেকটাই লোপ পেয়েছে। অভাব তার আজ নিত্যসঙ্গী। ওষুধ কেনার পয়সাও তার নেই। কদিন আগেও তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে আরামবাগ ক্লাবে পড়েছিলেন। দু’দিন পর এক ফুটবলার ওয়াজেদ গাজীর নাতিকে ফোন করে তার নানার অবস্থা জানান। পরে ক্লাব থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করে ওস্তাদকে পাঠিয়ে দেয়া হয় যশোরে তার বড় ছেলে হাসান গাজী দুলুর কাছে। দিনদশেক পর দুলু বাবাকে দিয়ে আসেন একমাত্র বোনের বাসায়। তারপর থেকে মেয়ের বাসাতেই আশ্রয় হয়েছে বাংলাদেশে অসংখ্য ফুটবলার তৈরির কারিগর ওয়াজেদ গাজীর। গত বছর স্ত্রীকে হারিয়ে এমনিতেই মুষড়ে পড়েছিলেন। তারও আগে নিজের অসুস্থতাকালীন সময়ে পন্ডিত পুকুরের হালদা রোডের বাড়িটি বিক্রি করতে হয়। কপর্দকশূন্য ওয়াজেদ গাজীর খোঁজ নেয়ার আজ আর কেউ নেই। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কাপতে কাপতে আর প্রচন্ড শ্বাসকষ্টের মধ্যোও ওস্তাদ ওয়াজেদ গাজী বলেন, আমি মাঠে যাবো, আর ঘরে থাকতে ভালো লাগে না। তিনি বলেন, কেউ আমার খোজ নেয় না, নিজের ছেলেরাও না।

এই কিংবদন্তী ফুটবলার, কোচ ওয়াজেদ গাজী খেলার মাঠকে ভালোবেসে সারা জীবন ক্লাব পাড়াতেই কাটিয়ে দিয়েছেন। ২০১২ সালের শুরুতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে দিনপনেরো পর আবার মাঠে ঠিকই ফিরে এসেছিলেন। ২০১৩ সালে বিজেএমসি কিংস কাপ খেলতে ভুটান সফর করেন। শত বারণ সত্ত্বেও অসুস্থ গাজীকে দলের বাইরে রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ২৩০০ মিটার উচ্চতার থিম্পুতে গিয়ে ঠিকই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পাঁচতলা টিম হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করায় আবার হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। ৮৫ বছর পার করেও ওয়াজেদ গাজী স্বপ্ন দেখেন মাঠে ফেরার। মাঠেই যেন তার মৃত্যু হয়- সেই কামনা করেন। আদি নিবাস সাতক্ষীরার ধলবাড়ীয়া। ১৯৬৩ সালে যশোরে বাড়ি করেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তার সংসার। ছেলেমেয়েরা সবাই বিবাহিত। তার বাবা সোলেমান গাজী কলকাতার বিখ্যাত জোসেফ কোম্পানিতে চাকরি করেতেন। পশ্চিমবাংলার চব্বিশ পরগনার বারাসাতে জন্ম তার। শৈশবে কলকাতায় ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন ওয়াজেদ গাজী চাকরি করতেন ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডে। এ বোর্ডের হয়ে অফিস লীগেও খেলতেন সেখানে। পরে ঢাকায় এসে চাকরি পান বিজি প্রেসে। সেই চাকরির সামান্য বেতনে মা-ভাইবোন, স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরন-পোষণ করেছেন।

বর্ণাঢ্য জীবনের পরিক্রমা শেষে পেছনে তাকালে ওয়াজেদ গাজীর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে একটি নাম তিনি রমণী সরকার। ১৯৫৮ সালে তার কাছেই হাতেখড়ি হয়। ১৯৫৮ সালে স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে কলকাতা লীগে অভিষেক হয় ছোট্ট এক কিশোরের। কলকাতা স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে জুনিয়র ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ দিতেন রমণী সরকার। গাজী তার নিজের ওস্তাদকে কৃতজ্ঞভরা চিত্তে স্মরণ করে বলেন, ‘উনার বদৌলতেই তো ফুটবলার হয়েছি।’ ১৯৬৩ সালে কলকাতা মোহামেডানে খেলেছিলেন। তারপর ফিরে আসেন দেশে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিজি প্রেসে প্রথম নাম লেখান। তারপর ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি (পরে বিজেএমসি), মোহামেডানে খেলে ’৭৬-এ ফিরে আসেন ওয়ান্ডারার্সে। পাঁচবার ছিলেন ঢাকা লীগ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। তবে ’৭৭ সালে ঢাকার মাঠ ছাড়লেও যশোর জেলা দলের হয়ে খেলেছেন আশির দশকের শেষ অবধি। ১৯৭৮ সালে কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয় তার। তখন যশোর ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন ইউনিট টিমকে অনুশীলন করান। রহমতগঞ্জের মোহাম্মদ আমিন ওয়াজেদ গাজীর জীবনের বাঁক বদলে দেন। রহমতগঞ্জের কোচের দায়িত্ব নিয়ে ’৮৩ পর্যন্ত কাটিয়ে দেন। পরের দু’মৌসুম ছিলেন আরামবাগে। ১৯৮৬ থেকে ’৮৮ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার কোচ ছিলেন। ১৯৮৭ সালে জাতীয় দলের কোচও হয়েছিলেন স্বল্প সময়ের জন্য। পরের বছর তার ঠিকানা হয় ফরাশগঞ্জে। ১৯৯০ সালে আরামবাগে ফিরেন। ’৯৬ থেকে ২০০২ পর্যন্ত ছিলেন আরামবাগের কোচ। দীর্ঘ কোচিং ক্যারিয়ারের প্রায় অর্ধেকটাই আরামবাগে কাটানোর পর ২০০৩ সালে যোগ দেন শেখ রাসেলে। তারপর ব্রাদার্স, বিজেএমসি হয়ে আবারও আরামবাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ওস্তাদ ওয়াজেদ গাজী। ৬০ বছর কাটিয়েছেন ক্লাব পাড়ায়। প্রত্যেক বছরেই দলগুলো তাকে কোচিং করানোর প্রস্তাব দিত। তিনি কখনোই কারও মুখাপেক্ষী হতেন না। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) তাকে মূল্যায়ন না করলেও ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থা তাকে সেরা কোচের পুরস্কার দিয়েছিল। এক ক্লাবের কোচ হয়েও ওয়াজেদ গাজী কখনোই বসে থাকতেন না। সময় পেলেই ছুটে যেতেন বিভিন্ন ক্লাবের অনুশীলনে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগের খেলাও মাঠে গিয়ে দেখতেন। জাতীয় দলের কোচদের অনুশীলন দেখতেন দূর থেকে দাঁড়িয়ে। চেষ্টা করতেন কোচিংয়ের নতুন নতুন পদ্ধতি শেখার। ফুটবল জীবনে অনেক নামকরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলেছেন। তাদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেছেন। কোচিংয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই ওয়াজেদ গাজীর। এএফসির ‘এ’, ‘বি’ কিংবা ‘সি’ লাইসেন্স কোর্স সম্পর্কে জানা ছিল না তার। জানতেও চাননি কখনও। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক কোচ আনোয়ার হোসেনকেই দীক্ষাগুরু মানতেন তিনি।

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ওস্তাদ বলেন, ‘ভারতের সুকুমার সমাজপতি, পিনাক ব্যানার্জি, অরুণ ঘোষ, চুনী গোস্বামী, বাংলাদেশের গোলাম সারোয়ার টিপু, কায়কোবাদের সঙ্গে খেলেছি এবং শেখার চেষ্টা করেছি। বলতে দ্বিধা নেই, পদ্ধতিগত কোনো সমস্যায় পড়লে টিপুর কাছে (গোলাম সরোয়ার) সাহয্য চাইতাম। দিল্লি এশিয়াডের আগে ১৯৮২ সালে স্মিথ নামে এক জার্মান ফুটবল কোচের প্রশিক্ষণ কৌশল আমার এখনও চোখে লেগে আছে।’ কোচিংয়ে আমার বীজমন্ত্র ছিল ফিটনেস উইথ দ্য বল।’ তার কথা, ‘প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের সিনিয়র সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করতাম। সেখান থেকে বড়জোর ম্যানেজার হতে পারতাম। কিন্তু কে চিনত আমাকে? আজ আমাকে সবাই চেনেন। জীবনে অনেক ফুটবলার তৈরি করেছি। একসময় কোচদের তেমন কেনা সুযোগ-সুবিধা ছিল না। অনুশীলনের জন্য দশটা বলও পেতাম না। এখন তো অনেক সুযোগ পাচ্ছেন কোচরা। আশিষ ভদ্র, কায়সার হামিদ, অলক, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, আলফাজদের মতো সাবেক তারকা খেলোয়াড়রাও কোচ হিসেবে তাকে পেয়েছেন। তৈরি করেছেন শত শত ফুটবলার। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে পাননি কোনো স্বীকৃতি। এখন পাচ্ছেন না তিনবেলা ভালো-মন্দ খাবার। অসুখে জোটে না ওষুধ।

যশোরের বর্তমান ফুটবলের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যশোরের ফুটবলের মান নিুমুখী। মানসম্মত খেলোয়াড় নেই। অথচ স্বাধীনতার আগ থেকেই যশোরের ক্রীড়াঙ্গন ছিল গৌরবময়। দেশ স্বাধীনের পরও সেই ধারা অব্যাহত ছিল নব্বইয়ের দশক পযর্ন্ত। জাতীয় ও বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় যশোরের খেলোয়াড়রা খেলেছেন সুনামের সঙ্গে। বর্তমানে জাতীয় মহিলা ফুটবল ও বয়সভিত্তিক নির্দিষ্ট কিছু ইভেন্ট ছাড়া যশোরের খেলোয়াড়দের আগের সেই অবস্থান নেই। জেলা ফুটবল এ্যাসোসিয়েশনের (ডিএফএ) অনীহার কারণে এমনটি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, যদিও যশোরের অনেক পরে খেলাধুলা চর্চা শুরু করে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে সাতক্ষীরা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়াসহ অনেক জেলা। সেই তুলনায় যশোরের ক্রীড়াঙ্গন পিছিয়েছে। তিনি বরেন এই অবস্থা একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি, দায়সারা গোছের ঘরোয়া লীগ পরিচালনা, ক্রীড়া সংগঠকদের মধ্যে মতানৈক্য, বিচক্ষণতার অভাবের কারণে যশোরের ক্রীড়াঙ্গনের মান নিম্মমুখী। এক সময় জাতীয় ফুটবল দলে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন যশোরের আবদুল হাকিম, কাওসার আলী, রকিবুল ইসলাম, মাসুদুর রহমান টনি, মাসুক মোহাম্মদ সাথী কাজী জামালসহ অনেকে। কিন্তু এখন আর কোন ফুটবলার তৈরি হয় না।

এ ব্যাপারে যশোর ডিএফএর সাবেক সাধারন সম্পাদক ও বর্তমান জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক এবিএম আখতারুজ্জামান বলেন, ওয়াজেদ গাজী এ দেশর সম্পদ, কিন্তু বাফুফে তার কোন খোজ নেয় না, সরকারও তার সাহায্যে এগিয়ে আসে না। তিনি বলেন, যশোর ডি এফএ লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফেডারেশনের নেতাদের হেলিকপ্টারে করে যশোরে নিয়ে আসে, কিন্তু ফুটবলের এই কারিগরের খোজ কেউ নেয় না। তিনি বলেন, আমি মাঝে মাঝে এসে ডাক্তার দেখাই, ঔষুধ কিনে দেয় আর ওনার মেয়ে যতটুকু পারে এই ভাবেই চলছে তার জীবনেল শেষ দিন গুলো। এ ব্যাপারে বিএকএসপির হকির চিপ কোচ কাউসার আহমেদ বলেন, ওয়াজেদ গাজীর মতো একজন গুণি খেলোয়াড়, জীবনের শেষ বেলায় এসে এমন অসহায় অবস্থায় বেচে থাকবেন এটা খুব লজ্জ্বার ব্যাপার। তিনি বলেন, আমি বাফুফের সাথে কথা বলবো আর আমি নিজেও তার কাছে যাবো।

এ ব্যাপারে সাবেক জাতীয় দলের পুটবলার মাসুক মোহাম্মাদ সাথী বলেন, আমাদের সকলের উচিৎ ওয়াজেদ গাজীর পাশে দাড়ানোর। তিনি বলেন, তারমত একজন ওস্তাদকে কেউ দেখবে না এটা সত্যিই খুব লজ্জ্বার। এ ব্যাপারে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব কবির বলেন,আমি তাকে ব্যাক্তিগত ভাবে এর আগেও সাহায্য করেছি এখনও তার পাশে আছি, তিনি বলেন, ওয়াজেদ গাজী এ দেশের শত শত নামকরা ফুটবলার তৈরি করেছে, তিনি ফুটবলের প্রাণ পুরুষ, জীবনের শেষ বেলায় এসে এমন একজন গুণি মানুষ এমন অবহেলায় থাকবে এটা মেনে নেওয়া যায় না।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com